নীলফামারী: নামকরণের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ

Murshid Ibne Masud Lohit
Written by
নীলফামারী: নামকরণের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ

নীলফামারী: নামকরণের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের অন্তর্গত নীলফামারী জেলা তার স্বতন্ত্র ভৌগোলিক অবস্থান এবং সমৃদ্ধ ইতিহাসের জন্য পরিচিত। এই জেলার নামকরণের পেছনে রয়েছে গভীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বিভিন্ন লোককথা, যার মধ্যে নীলের চাষাবাদই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এই নিবন্ধে নীলফামারীর নামকরণের বিভিন্ন তত্ত্ব ও সেগুলোর ঐতিহাসিক গ্রহণযোগ্যতা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

নীল চাষের প্রেক্ষাপট ও সংশ্লিষ্ট শব্দাবলি

নীলফামারীর নামকরণ বুঝতে হলে প্রথমে নীল চাষের সঙ্গে জড়িত কিছু মৌলিক ধারণা স্পষ্ট করা প্রয়োজন:

  • নীল গাছ (True Indigo / Indigofera tinctoria): এটি এমন একটি উদ্ভিদ যার পাতা থেকে গাঢ় নীল রং তৈরি হয়। এই রং প্রাকৃতিক 'ইন্ডিগো ডাই' বা নীল নামে পরিচিত এবং এটি কাপড় রং করতে ব্যবহৃত হতো।
  • নীলকুঠি: ব্রিটিশ বা ফরাসি নীলচাষীদের দ্বারা পরিচালিত একটি অফিস বা গুদামঘর, যেখানে নীল চাষ করা হতো এবং নীল প্রক্রিয়াজাত করা হতো। একে এক প্রকার কারখানা হিসেবেও গণ্য করা যায়। উল্লেখযোগ্য নীলকুঠির মধ্যে সৈয়দপুরের লুই বোনোর কুঠি অন্যতম।
  • নীলকর: ইংরেজ জমিদার বা কর্মকর্তারা যারা ভারতীয় কৃষকদের জোরপূর্বক নীল চাষে বাধ্য করতেন।

১৭৭০ সালের পর ফরাসি ও ইংরেজ বণিকরা এই অঞ্চলে নীল চাষ শুরু করে। ১৭৭৭ সালে ফরাসি বণিক লুই বোনো সৈয়দপুরে একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। এই নীল চাষ ছিল অত্যাচার ও নির্যাতনের ইতিহাস, যেখানে কৃষকদের জমি দখল করে জোরপূর্বক নীল চাষ করানো হতো।

নামকরণের প্রধান ও সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্ব

১. ইন্ডিগো ফার্ম তত্ত্ব (সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য)

এই তত্ত্বটি নীলফামারীর নামকরণের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করে। ব্রিটিশরা নীল চাষের জন্য এখানে 'ইন্ডিগো ফার্ম' (Indigo Farm) স্থাপন করেছিল। স্থানীয় সাধারণ মানুষ যারা ইংরেজি বা ফরাসি ভাষা সম্পর্কে অবগত ছিল না, তারা 'ফার্ম' শব্দটিকে স্থানীয় উচ্চারণে 'ফামার' হিসেবে গ্রহণ করে। এভাবেই 'নীল ইন্ডিগো ফার্ম' থেকে 'নীল ফামার' এবং পরবর্তীতে 'নীলফামারী' নামটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়।

এই তত্ত্বের সপক্ষে জোরালো ঐতিহাসিক প্রমাণ বিদ্যমান:

  • ১৭৭০ সালের পর ফরাসি ও ইংরেজদের নীল চাষ এই অঞ্চলে শুরু হয়।
  • সৈয়দপুর, ডোমার ও জলঢাকায় ইন্ডিগো ফার্মের অস্তিত্ব ছিল। সৈয়দপুর রেল স্টেশনের কাছে এখনও পুরনো নীলকুঠির নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।
  • ১৮৪৩ সালে উইলিয়াম প্রিন্সেপের ডায়েরিতে 'নীলফামারের কুঠিতে আগুন লাগানো হয়েছে' মর্মে প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায়।
  • ১৮৫৭ সালে প্রথম সরকারি নথিতে 'Nilfamary' (পরবর্তীতে 'Nilphamari') উল্লেখ করা হয়।
  • ১৮৭২ সালের জরিপ ম্যাপে 'নীলফামার' স্থানটি চিহ্নিত ছিল।

২. ব্রিটিশ নীল চাষ তত্ত্ব (শক্তিশালী সমর্থন)

এটি ইন্ডিগো ফার্ম তত্ত্বেরই একটি পরিপূরক রূপ। এই তত্ত্বের মূল যুক্তি হলো, ১৮শ শতকে ব্রিটিশরা এখানে নীল চাষ করত এবং 'নীল' শব্দের সাথে 'ফামার' (যা 'খামার' বা ফার্ম থেকে এসেছে) যুক্ত হয়ে 'নীলফামার' নামটির উৎপত্তি। এই তত্ত্বও উপরোক্ত ঐতিহাসিক প্রমাণাদি দ্বারা সমর্থিত।

নামকরণের অন্যান্য প্রচলিত তত্ত্বসমূহ

নীলফামারীর নামকরণ নিয়ে আরও কিছু তত্ত্ব প্রচলিত আছে, যার মধ্যে অনেকগুলোই ঐতিহাসিক প্রমাণের অভাবে দুর্বল বা অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়:

৩. জমিদারি পরিভাষা তত্ত্ব (অগ্রহণযোগ্য)

  • যুক্তি: 'ফার্মার' শব্দের স্থানীয় রূপান্তর থেকে 'ফামার' হয়েছে। ১৮৯১ সালের কিছু জমিদারি নথিতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
  • বিরুদ্ধে যুক্তি: দশ হাজারেরও বেশি ব্রিটিশ নথিতে 'ফামার' উচ্চারণের অনুপস্থিতি এই তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দেয়।

৪. প্রশাসনিক বিবর্তন তত্ত্ব (মাঝারি গ্রহণযোগ্য)

  • যুক্তি: 'Nilformari' থেকে ধীরে ধীরে 'Nilphamari' তে রূপান্তরিত হয়েছে।
  • সপক্ষে প্রমাণ: ১৯৩১ সালের আদমশুমারিতে বানানটি স্থিতিশীল হয়।
  • বিরুদ্ধে যুক্তি: এই রূপান্তর প্রক্রিয়ার সুনির্দিষ্ট নথি বা প্রমাণ নেই।

৫. নীলসাগর জলাধার তত্ত্ব (যুক্তিহীন)

  • যুক্তি: অনেকে বিশ্বাস করেন যে নীলসাগর দিঘি থেকে নীলফামারীর নাম এসেছে। এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থান এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।
  • বিরুদ্ধে যুক্তি: নীলসাগর দিঘির পূর্ব নাম ছিল 'বিরাট দিঘি', যা ১৯৭৯ সালে 'নীলসাগর' নামে পুনঃনামকরণ করা হয়। অথচ নীলফামারীর নীল চাষ সম্পর্কিত ইতিহাস ১৭৭০ সাল থেকেই বিদ্যমান। তাই এই তত্ত্বটি কালানুক্রমিকভাবে যুক্তিহীন।

৬. কোচ রাজবংশী ভাষা তত্ত্ব (দুর্বল)

  • যুক্তি: কোচ রাজাদের আমলে 'ফামার' মানে 'উর্বর জমি' বোঝাতো।
  • সপক্ষে প্রমাণ: কোচ রাজাদের শাসনকাল ১৫৩০ সাল থেকে ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত ছিল।
  • বিরুদ্ধে যুক্তি: ২০২০ সালে ভাষাবিদ ড. অরুণ বর্মার গবেষণায় কোচ ভাষার অভিধানে 'ফামার' শব্দের অনুপস্থিতি এই তত্ত্বকে দুর্বল করে।

৭. পৌরাণিক ও লোককথা ভিত্তিক তত্ত্বসমূহ (অগ্রহণযোগ্য/কাল্পনিক)

কিছু লোককথা এবং পৌরাণিক কাহিনীও নামকরণের উৎস হিসেবে প্রচলিত আছে, তবে এগুলোর কোনো ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক ভিত্তি নেই:

  • নীল নামক রাক্ষসের রাজ্য: স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে একসময় 'নীল' নামের একটি রাক্ষসের রাজ্য ছিল। এর কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই।
  • মাটির নীলাভ রং তত্ত্ব: কিছু এলাকায় মাটির রং নীলচে হওয়ায় এই নামকরণ হয়েছে। এর কোনো ভূতাত্ত্বিক ভিত্তি নেই।
  • নীল নদীর পাশে ফাঁড়ি তত্ত্ব: 'নীল' নদীর পাশে একটি 'ফাঁড়ি' ছিল, যা থেকে 'নীল ফাঁড়ি' এবং পরে 'নীলফামারী' নাম এসেছে। তবে নীল নামে কোনো নদী বা ফাঁড়ির অস্তিত্বের প্রমাণ নেই।
  • নীল নামে প্রভাবশালী ব্যক্তি তত্ত্ব: 'নীল' নামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। এটি লোককথা হলেও কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।
  • নীলফামারী নামে নারী তত্ত্ব: 'নীলফামারী' নামে এক রক্ষিতা বা নারীর গল্প প্রচলিত। এটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।

উপসংহার

উপসংহারে বলা যায়, নীলফামারীর নামকরণ মূলত এই অঞ্চলে ব্যাপক হারে সংঘটিত নীল চাষ এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাবে সৃষ্ট 'ইন্ডিগো ফার্ম'-এর স্থানীয় উচ্চারণের পরিবর্তিত রূপ থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। ঐতিহাসিক নথি, জরিপ ম্যাপ, এবং লিখিত প্রমাণাদি এই তত্ত্বকেই সবচেয়ে জোরালোভাবে সমর্থন করে। অন্যান্য তত্ত্বগুলো হয় অপ্রচলিত, নথিপত্রের অভাবে দুর্বল, অথবা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।

3/related/default