প্রারম্ভিকা: নদী, কৃষি ও মানুষের মিলনস্থল
বাংলাদেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ে অবস্থিত দেবীগঞ্জ উপজেলা। করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষে বিস্তৃত এই অঞ্চল কৃষি, নদী, সীমান্ত বাণিজ্য ও সংস্কৃতির এক অনন্য সমাহার। প্রতিদিন ভোরে নদীর কুলকুলে জেগে ওঠে এখানে হাজার হাজার কৃষক ও জেলেদের জীবন।
শীতের ভোরে, করতোয়া নদীর কুয়াশাচ্ছন্ন পাড়ে কয়েকজন জেলে বাঁশের জাল নিয়ে নেমেছেন মাছ ধরতে। ধানের মাঠ থেকে আসে শিশিরের গন্ধ, আর বাজারে ধেয়ে আসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। এসব দৃশ্য দেবীগঞ্জের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
প্রশাসনিক ও ভৌগোলিক কাঠামো
দেবীগঞ্জ উপজেলার আয়তন প্রায় ৩০৯.৬৯ বর্গকিলোমিটার। এটি পঞ্চগড় জেলার উত্তরে অবস্থিত এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সাথে ৩৫.৯ কিলোমিটার সীমান্ত শেয়ার করে। উত্তরদিকে বোদা উপজেলা, দক্ষিণে খানসামা উপজেলা ও নীলফামারী জেলা, পূর্বে ভারতের জেলা উত্তর দিনাজপুর ও ডোমার উপজেলা, পশ্চিমে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা রয়েছে।
উপজেলা প্রশাসনিকভাবে গঠিত:
- ১ পৌরসভা: দেবীগঞ্জ পৌরসভা
- ১০ ইউনিয়ন পরিষদ:
- ১) শালডাঙা
- ২) কালীগঞ্জ
- ৩) মালিগাঁও
- ৪) চান্দামারা
- ৫) দেবীগঞ্জ
- ৬) চিরামপাড়া
- ৭) গোমদা
- ৮) বালিয়ারচর
- ৯) কালিতলা
- ১০) ভবানীপুর
- ১০১ গ্রাম
- ১০৩ মৌজা
সীমান্তবর্তী এই উপজেলাটি করতোয়া ও আত্রাই নদী দ্বারা সমৃদ্ধ, যা কৃষির জন্য উর্বর মাটি ও পানি সরবরাহ করে।
জনসংখ্যা ও সামাজিক কাঠামো
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের হিসাব মতে, দেবীগঞ্জ উপজেলায় জনসংখ্যা প্রায় ২৬৭,০০০। এর মধ্যে পুরুষ ১৩৫,০০০ এবং নারী ১৩২,০০০।
ধর্মীয় বিভাজনে:
- মুসলিম: ৭৫.৫৯%
- হিন্দু: ২৪.১৭%
- অন্যান্য: ০.২৪%
শিক্ষার হার ৪৭.৬৯%, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় কিছুটা নীচে। শহুরে বসতি মাত্র ৬.৮১%, অর্থাৎ জনসংখ্যার বড় অংশ গ্রামীণ পরিবেশে বসবাস করে।
ইতিহাস: জমিদারবাড়ি থেকে মুক্তিযুদ্ধ
দেবীগঞ্জের ইতিহাস জমিদার আমলের ঐতিহ্যে ভরপুর। শালডাঙা ইউনিয়নের পুরনো জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ আজো সে সময়ের গল্প বলে। নৃপেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ছিলেন এক কিংবদন্তি জমিদার, যিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থাপনায় বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়, করতোয়া নদী হয়ে ছিল গোপন মুক্তিযোদ্ধাদের আগমন-প্রস্থান পথ। স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা বলতেন, নদীর পাড়ে গোপন আস্তানা ও অস্ত্র গুদাম ছিল। যুদ্ধকালীন স্মৃতি আজো স্থানীয়দের মুখে মুখে বেঁচে আছে।
অর্থনীতি: কৃষি, মাছ ও সীমান্ত বাণিজ্য
দেবীগঞ্জের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি। এখানে ধান, আলু, গম, পাট, ভুট্টা, গাজর ও বিভিন্ন ফলের চাষ ব্যাপক। প্রতিবছর এখানে উৎপাদিত ধানের পরিমাণ প্রায় ৯৮,৫৯৭ মেট্রিক টন। মাছ চাষও বড় আয়ের উৎস; ৪,৮৫৮ পুকুর থেকে বছরে ৩,১৯৫ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়।
পশুপালন, হাঁস-মুরগি খামার ও ক্ষুদ্র ব্যবসাও অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী হাট-বাজারগুলো বাণিজ্যের জন্য প্রাণকেন্দ্র।
তবে সীমান্ত এলাকায় অবকাঠামোর অভাব, সুরক্ষা ঝুঁকি ও জলবায়ুর প্রভাবে সেচ ও কৃষির চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: অগ্রগতির চিত্র
উপজেলায় ৬৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ১০টি কলেজ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে দেবীগঞ্জ কলেজ, নৃপেন্দ্র নারায়ণ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। শিক্ষা মানোন্নয়নে এখনও সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন।
স্বাস্থ্যখাতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব সমস্যার কারন। শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কিছুটা বেশি।
পরিবহন ও যোগাযোগ
দেবীগঞ্জে মোট প্রায় ৫০০ কিলোমিটার রাস্তা, যার মধ্যে পাকা ও কাঁচা রাস্তার মিশ্রণ রয়েছে। সড়ক যোগাযোগে মাইক্রোবাস, অটো রিকশা জনপ্রিয়।
বিশেষ করে চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করেছে। তবে বন্যার সময় যোগাযোগ ব্যাহত হয়।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
দেবীগঞ্জের মানুষের সংস্কৃতি বহুমাত্রিক। প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা, ঈদ, নববর্ষ, লোক মেলা ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মানুষের মিলন হয়। বাঁশ ও বেতের হস্তশিল্প, নকশিকাঁথা, আর্টিস্যান শিল্প এখানে সমৃদ্ধ।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যত সম্ভাবনা
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বার্ষিক বন্যা ও খরার প্রভাবে কৃষকরা আজও সংকটে। শিক্ষার মান উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ, সীমান্ত নিরাপত্তা ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন।
অপরদিকে করতোয়া নদী ও সীমান্ত বাণিজ্যের সদ্ব্যবহার, পর্যটন খাতের উন্নয়ন, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির প্রয়োগ ভবিষ্যতে দেবীগঞ্জের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।
উপসংহার
দেবীগঞ্জ উপজেলা শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক সত্তা নয়, এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, সীমান্ত বাণিজ্য ও নদীর পানির মিশেলে গড়ে ওঠা জীবন্ত জনপদ। যেখানে হাজারো মানুষের পরিশ্রম আর স্বপ্ন গাঁথা। পরিকল্পিত উন্নয়ন ও সুষ্ঠু নীতি প্রয়োগে দেবীগঞ্জ হতে পারে বাংলাদেশের উত্তরের অন্যতম উন্নত ও সমৃদ্ধ উপজেলা।