বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া সাতটি প্রাচীন শহর

Murshid Ibne Masud Lohit
Written by

বাংলাদেশের ইতিহাস কেবল নদী, মাঠ বা জঙ্গলের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়। এই ভূখণ্ডে হাজার বছরেরও বেশি আগে এমন নগর গড়ে উঠেছিল, যা প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক এবং ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু নদীভাঙন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জনবসতির স্থানান্তরের কারণে অনেক নগর বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের খনন ও গবেষণার মাধ্যমে আজও আমরা তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাই।

এই নিবন্ধে আমরা এমন সাতটি শহরের কথা আলোচনা করব, যেগুলো প্রমাণভিত্তিক, প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং সত্যিই হারিয়ে গেছে।

  1. মহাস্থানগড় (Mahasthangarh) – বগুড়া

    অবস্থান: বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা

    সময়কাল: খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতক – খ্রিষ্টীয় ১২শ শতক

    মহাস্থানগড় বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে একটি। এটি প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানী ছিল। নগরীর ধ্বংসাবশেষ থেকে জানা যায়, এটি ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত একটি নগর, যেখানে প্রশাসনিক ভবন, দুর্গ, জলাধার, রাস্তা এবং বসতি অঞ্চলের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

    বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব:

    • ব্রাহ্মী শিলালিপি ও প্রাচীন মুদ্রা থেকে জানা যায়, নগরটি খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে সক্রিয় ছিল।
    • পাল ও সেন যুগে মহাস্থানগড় বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত ছিল।
    • নগরটি প্রতিরক্ষামূলক প্রাচীর দ্বারা ঘেরা ছিল, যা প্রমাণ দেয় যে এটি প্রশাসনিক ও সামরিক কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।

    পতন ও হারানো ইতিহাস:

    নদীর গতিপথ পরিবর্তন, প্রশাসনিক কেন্দ্রের স্থানান্তর, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে নগরটি ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে পড়ে। বর্তমানে এটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষিত, যা প্রাচীন বাংলার নগর পরিকল্পনার দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিত।

  2. ওয়ারী‑বটেশ্বর (Wari‑Bateshwar) – নরসিংদী

    অবস্থান: নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলা

    সময়কাল: খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতক

    ওয়ারী‑বটেশ্বর প্রাচীন বাণিজ্য নগর। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া মুদ্রা, লৌহ এবং চীন ও রোমান কাচের নিদর্শন প্রমাণ করে এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল।

    বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব:

    • নগরটি প্রাচীন লৌহযুগে গড়ে উঠেছিল।
    • এখানে ঘিরা প্রাচীর, রাস্তা ও বাসস্থান খুঁজে পাওয়া গেছে, যা প্রমাণ দেয় এটি এক পরিকল্পিত নগর।
    • প্রাচীন মুদ্রা ও বাণিজ্যিক সরঞ্জাম ইঙ্গিত দেয় যে, এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যুক্ত ছিল।

    পতন ও হারানো ইতিহাস:

    নদীর গতিপথ পরিবর্তন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং জনবসতির স্থানান্তরের কারণে নগরটি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়। এটি বাংলাদেশের প্রাচীন নগরায়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।

  3. ময়নামতি – কুমিল্লা

    অবস্থান: কুমিল্লা জেলা

    সময়কাল: ৭ম – ১২শ শতক

    ময়নামতি ছিল পাল যুগের বৌদ্ধ ধর্মীয় নগর ও শিক্ষাকেন্দ্র। এটি কেবল ধর্মীয় নয়, শিক্ষাগত ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

    বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব:

    • শহরে অনেক বিহার, মন্দির এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
    • পাল রাজাদের সময় এটি বৌদ্ধ সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।
    • নগরের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা প্রমাণ করে যে, এটি শুধুমাত্র ধর্ম নয়, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

    পতন ও হারানো ইতিহাস:

    পাল রাজাদের পতনের পর নগরের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমে যায়। বর্তমানে এটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে সংরক্ষিত এবং বৌদ্ধ সভ্যতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ।

  4. পানাম নগর – সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ

    অবস্থান: সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ

    সময়কাল: ১৩শ – ১৯শ শতক

    পানাম নগর ছিল বণিক ও শিল্পপতিদের বসতি এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে বাণিজ্যের কেন্দ্র। নদীপথ ও বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে এটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ নগর ছিল।

    বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব:

    • মুঘল ও ইউরোপীয় স্থাপত্যের মিশ্রণ।
    • ধনী বণিক ও ব্যবসায়ীদের বাসভবন।
    • নগরটি নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল, যা বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে সহজ করতো।

    পতন ও হারানো ইতিহাস:

    ১৯৪৭ সালের বিভাগ, নদীপথের পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্রের স্থানান্তরের কারণে নগরটি জনশূন্য হয়ে পড়ে। বর্তমানে ধ্বংসপ্রায় ভবন এবং নিস্তব্ধ রাস্তা শহরের এক ইতিহাসিক চিত্র বহন করে।

  5. হালিশহর – চট্টগ্রাম

    অবস্থান: চট্টগ্রাম জেলা

    সময়কাল: ৯শ – ১৪শ শতক

    প্রাচীন বন্দর নগর হিসেবে হালিশহর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এটি বঙ্গোপসাগরের বাণিজ্যিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

    বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব:

    • সমুদ্র বন্দর, নৌকা ঘাট এবং বাণিজ্যিক বাজার।
    • মধ্যযুগে এটি বাণিজ্য ও শুল্ক আদায়ের কেন্দ্র।

    পতন ও হারানো ইতিহাস:

    সমুদ্রপথের পরিবর্তন, নদীভাঙন ও ব্যবসায়িক কেন্দ্রের স্থানান্তরের কারণে নগরটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

  6. রাজবাজার – রাজশাহী

    অবস্থান: রাজশাহী জেলা

    সময়কাল: ১০শ – ১৬শ শতক

    রাজবাজার ছিল আঞ্চলিক প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এখানে বহু বাজার, মসজিদ ও প্রশাসনিক ভবনের নিদর্শন পাওয়া গেছে।

    পতন ও হারানো ইতিহাস:

    নদী পরিবর্তন, প্রশাসনিক স্থানান্তর এবং জনসংখ্যার স্থানান্তরের কারণে নগরটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

  7. ভুজঙ্গর / বর্ধনকোট – সিলেট

    অবস্থান: সিলেট অঞ্চল

    সময়কাল: ৯শ – ১২শ শতক

    ভুজঙ্গর বা বর্ধনকোট ছিল সিলেট অঞ্চলের প্রাচীন রাজকেন্দ্র। প্রত্নলিপি ও সাহিত্য থেকে জানা যায় এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল।

    পতন ও হারানো ইতিহাস:

    নদীভাঙন, ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নগরটি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়।

উপসংহার

এই সাতটি শহর একসময় বাংলাদেশের সমৃদ্ধ নগরায়নের সাক্ষী ছিল। মহাস্থানগড় থেকে পানাম নগর পর্যন্ত প্রতিটি নগরই রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করত। নদীভাঙন, প্রাকৃতিক পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক কারণে এগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আজও আমাদেরকে এই ভূখণ্ডে সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে স্মরণ করায়।

3/related/default